দেশের শেয়ারবাজারে কিছুটা মন্দাভাব দেখা দিলেও স্বমহিমায় ছুটে চলছে বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার। প্রতিনিয়ত কোম্পানিটির শেয়ার দাম হু হু করে বাড়ছে। এক মাসের মধ্যেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম প্রায় হাজার টাকা বেড়েছে। আর দেড় বছরে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। এরপরও থামছে না কোম্পানিটির শেয়ার দাম বৃদ্ধির ধারা।
ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল ও ভিটসহ কয়েকটি প্রসাধন পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করা কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৭ সালে। ভালো ব্যবসার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের মোট অঙ্কের লভ্যাংশ দেয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার বরাবরই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। যে কয়টি তালিকাভুক্ত তার বড় অংশেরই পরিশোধিত মূলধন খুবই কম। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিনেও এসব কোম্পানি মূলধন বাড়ায়নি। ফলে শেয়ারের সংখ্যাও কম। অবার স্বল্প সংখ্যক শেয়ারের মধ্যে সিংহভাগই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চাইলেও এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারেন না। রেকিট বেনকিজার তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান।’
বহুজাতিক এই কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা যেমন কম, তেমনি নিয়তিম ভালো পারফর্মেন্স করছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দিচ্ছে। যে কারণে শেয়ারের অনেক দাম হওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ এসব কোম্পানির দিকে ঝুঁকছেন। তবে সম্প্রতি যে হারে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ‘রেকিট বেনকিজার নিঃসন্দেহ খুবই ভালো কোম্পানি। কিন্তু কোম্পানিটির শেয়ার দাম ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা হয়ে গেছে। সুতরাং বিনিয়োগকারীদের চিন্তাভাবনা করেই এই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে কোম্পানিটির মুনাফা ও লভ্যাংশের অতীত ইতিহাস ভালো করে বিশ্লেষণ করতে হবে।’
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) শেয়ারবাজারে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমলেও তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি রেকিট বেনকিজারের ওপরে। বরং দিনের লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দাম আগের দিনের তুলনায় ১৫৬ টাকা ১০ পয়সা বেড়েছে।
এই দাম বাড়ার ফলে অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দামের ব্যবধান অনেকটাই আকাশ-পাতাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কোম্পানিটির সঙ্গে রেকিট বেনকিজারের শেয়ার দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৩২ টাকা।
শুধু সম্প্রতি নয়, কোম্পানিটির শেয়ার দাম ধারাবাহিকভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৩ মে রেকিট বেনকিজারের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২ হাজার ৪৭ টাকা ৬০ পয়সা। কয়েক দফা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ৩ হাজার ১১৫ টাকা ১০ পয়সায় ২০১৯ সাল শেষ করে কোম্পানিটি।
এরপর বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের শুরুতে কোম্পানিটির শেয়ার দামে কিছুটা পতন হয়। ১৬ জানুয়ারি প্রতিটি শেয়ারের দাম কমে ২ হাজার ৭৭৬ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে আসে। অবশ্য এরপরেই আবার দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
গত বছরের মার্চে দেশে করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ার পর শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। পতনের ধকল সামলাতে না পেরে টানা ৬৬ দিন দেশের শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ রাখা হয়। মে মাসে আবার লেনদেন শুরু হলে প্রথম কয়েকদিন রেকিট বেনকিজারের শেয়ার দাম কমে।
তবে মহামারি করোনার মধ্যে মুনাফায় উল্লম্ফন হয় রেকিট বেনকিজারের। যার ওপর ভর করে কোম্পানিটি ২০১৯ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের রেকর্ড ১২৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। এমন বড় লভ্যাংশ ঘোষণার প্রভাব পড়ে কোম্পানিটির শেয়ার দামেও। ফলে দফায় দফায় দাম বাড়ে। হু হু করে দাম বাড়ায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চার হাজার টাকায় উঠে যায় কোম্পানিটির শেয়ার দাম।
এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ার প্রতি মুনাফা হয়েছে ৯১ টাকা ৪৪ পয়সা। ২০২০ সালের হিসাব বছর শেষ হলেও এখনো কোম্পানিটি লভ্যাংশ সংক্রান্ত তথ্য জানায়নি। শিগগির পরিচালনা পর্ষদের সভা করে ২০২০ সালের লভ্যাংশ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে কোম্পানিটি।
লভ্যাংশ ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম বাড়ার পালে আরও হাওয়া লেগেছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে এখন কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৭৩ টাকা। অবশ্য মঙ্গলবার লেনদেনের এক পর্যায়ে শেয়ারের দাম ৪ হাজার ৮৯৩ টাকা ৯০ পয়সা পর্যন্ত ওঠে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ওষুধ ও রাসায়নিক খাতের প্রতিষ্ঠান রেকিট বেনকিজার ২০১৮ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ৭০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৭ সালে ৭৯০ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৭৭৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ৬৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় এই প্রতিষ্ঠানটি।
নিয়মিত এমন বড় লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ মাত্র ৪ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর শেয়ার সংখ্যা ৪৭ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ৮২ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ারই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। সে হিসাবে শেয়ারহোল্ডারদের বড় লভ্যাংশ দিলেও তার সিংহভাগই নিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা।
অপরদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ শেয়ার। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩ দশমিক ৯০ শতাশ ও বিদেশিদের কাছে ৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বাকি ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সরকারের কাছে।
সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব নাজমুল আরিফিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা পণ্যের মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করি না। আমরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, আমাদের মান মেইন্টেইন করে চলতে হয়। আমাদের ইন্টারনাল রেজুলেশন আছে, সেগুলো মেনে চলতে হয়। পণ্যের মান ভালো না থাকলে, ক্রেতা থাকবে না। কাল যদি আমাদের থেকে একটা ভালো পণ্য আসে, তাহলে ক্রেতা সেখানে চলে যাবে।’
এ সময় রেকিট বেনকিজারের শেয়ারের দাম বাড়ার প্রবণতা এবং বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলোর বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করবো না।’